Golperjogot

Golperjogot

প্রেম কাহিনী – স্কুল জীবনের প্রেমের গল্প পর্ব 18 | Golpo

নাজনীন আন্টিকে সঙ্গে করে সব ঘর দেখিয়ে দোতালায় মামার রুমে নিয়ে গেল।
দরজা খুলে ঢুকে ঝর্ণা রুমের চারদিকে একবার তাকিয়ে আশ্চার্য হয়ে স্থানুবৎ দাড়িয়ে পড়ল । কি সুন্দর ভাবে সাজান রুমটা। এক সাইডে ডবল বেডের খাট। ঝর্ণার মনে হল সাইফুল ছাড়া আর কেউ এই খাটে ঘুমায় না। সে দীর্ঘ দিন নেই, তবু যেন কেউ প্রতিদিন বিছানাটা ঝেড়ে ঠিকঠাক করে রেখেছে। অন্য তিন সাইডে আলমারী, বুক কেস, ওয়ার্ডড্রব ও ড্রেসিং টেবিল রয়েছে। সেগুলাে যে প্রতিদিন ঝাড়ামুছা করা হয় তা বুঝতে পারল। ডেসিং টেবিলের ছােট থাকগুলাে টানা গ্লাস সিস্টেম। থাকগুলােতে কত রকমের দেশীবিদেশী প্রসাধনী। সেগুলাের প্রায় সব ঝর্ণার পছন্দ। টেবিলের উপর সাইফুলের চারটে ফটো পাশাপাশি দাড় করান রয়েছে।

একটা স্কুলে পড়ার সময়কার, একগাদা বই হাতে। করে তােলা। দ্বিতীয়টায় সাইফুল লুংগী ও গেঞ্জী পরে রিক্সা চালাচ্ছে। তৃতীয়টা ভার্সিটির আর্টস বিল্ডিংয়ের সামনে সে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। চতুর্থটা একজনকে কুংফু শেখাচ্ছে। ফটোতে সাইফুলকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে দেখে ঝর্ণা ভাবল, তাকে দেখলে ঘৃণা হত বলে তার এই সুন্দর চেহারা এতদিন লক্ষ্য করে নি। দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে। আরাে আশ্চর্য হয়ে গেল। চারপাশের দেওয়ালে চারটে বড় অয়েল পেন্টিং রয়েছে। প্রত্যেকটাতে পাহাড়ী ঝর্ণার দৃশ্য। আর প্রত্যেকটার নিচে আলাদা কাগজে কিছু হাতে লিখে গাম দিয়ে সেঁটে দেয়া হয়েছে। ঝর্ণা এগিয়ে গিয়ে পড়তে লাগল। | (১) ঝর্ণা, তুমি এই পাহাড়ী ঝর্ণার মত চঞ্চল। তােমার চঞ্চলতা আমাকে বড় মুগ্ধ
(২) ঝর্ণা, তুমি ঝর্ণার মত সর্বদা আমার হৃদয়ে বয়ে চলেছ। যার শব্দ আমি অহরহ শুনে তৃপ্তি পাই।

(৩) ঝর্ণা, তুমি আমার জীবনের স্বপ্ন। তােমাকে নিয়ে এই রকম ঝর্ণার পাশে দাঁড়িয়ে বলব, সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব সৃষ্টি এই ঝর্ণার চেয়ে শত শত গুণ বেশি সুন্দরী তুমি; তােমাকে আমি আমার সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে ভালবাসি।’

(৪) ঝর্ণা, তােমাকে পাব কিনা জানি না, তবে চিরকাল তােমার স্মৃতি এই ঝর্ণার স্রোতের মতাে আমার হৃদয়ের শিরা উপশীরায় রক্তের সঙ্গে আমৃত্যু বইতে থাকবে। লেখাগুলাে পড়ে ঝর্ণার মাথা ঘুরতে লাগল। কোনাে রকমে টলতে টলতে টেবিলের কাছে এসে সাইফুলের ফটোগুলােতে একবার হাত বুলিয়ে মুচ্ছা যেয়ে মেঝেয় পড়ে গেল।

নাজনীন আন্টিকে আসা অব্দি তার মন খারাপ দেখেছে এবং এই ঘরে ঢােকার পর থেকে তার মুখের চেহারা আরাে খারাপ হতে লক্ষ্য করেছে। এখন পড়ে যেতে তাড়াতাড়ি তার কাছে এসে বসে কয়েকবার আন্টি বলে ডাকল। সাড়া না পেয়ে দু’জন। কাজের মেয়েকে ডেকে ধরাধরি করে মামার খাটে শুইয়ে দিল। তাদের একজনকে চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিতে বলে সে ফ্যান ছেড়ে দিল।

 

কিছুক্ষণের মধ্যে ঝর্ণার জ্ঞান ফিরল।
নাজনীন আন্টিকে চোখ খুলতে দেখে ভয়ার্তস্বরে জিজ্ঞেস করল, এখন কেমন বােধ করছেন? ঝর্ণা জ্ঞান ফিরে পেয়ে সাইফুলের খাটে নিজেকে শুয়ে থাকতে দেখে হৃদয়ে যেন কি রকম একটা শান্তি অনুভব করল । ভাবল, আল্লাহ কি আমাকে আবার এই বিছানায় শােবার ভাগ্য করবেন? নাজনীনের কথাশুনে উঠে বসে বলল, মাথাটা হঠাৎ ঘুরে উঠতে

পড়ে গেলাম। এখন ভালাে লাগছে। চল, আমরা এ ঘর থেকে যাই। বেরিয়ে আসা সময় চিন্তা করল, ছি ছি, নাজনীন কি ভাবছে কি জানি।। | নিজের রুমে এসে নাজনীন বলল, আপনি আরাে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন। আমি আসছি বলে সে বেরিয়ে গেল।

ততক্ষণ মনিরা ফিরেছে। মেয়ের মুখে ঝর্ণার কথা শুনে তাড়াতাড়ি এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে এসে সালাম বিনিময় করে বলল, এটা খেয়ে নিন, সুস্থ বােধ করবেন। ঝর্ণা দুধটা খেয়ে প্রসঙ্গ এড়াবার জন্য বলল, নাজনীনের কাছে শুনলাম, আপনি মাজারে গিয়েছিলেন? মনিরা বলল, হ্যা। সাইফুল যাতে তাড়াতাড়ি ফিরে আসে এবং তার সুস্থ্যতার জন্য মীরপুরের ও হাইকোর্টের মাজারে মানত করে এলাম।

ঝর্ণা বলল, হাদিসে পড়েছি, কোনাে অলি আল্লাহর মাজার জিয়ারত করা যায়েজ হলেও সেখানে মানত করা, আগরবাতি এবং টাকা-পয়সা দেয়া নাযায়েজ। হাদিসে আছে, আল্লাহর রাসূল (দঃ) বলিয়াছেন, “তােমাদের কারাে কিছু চাওয়ার দরকার হলে সরাসরি আল্লাহপাকের কাছে চাইবে। তিনি সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা। তাঁর ইচ্ছা। ব্যতিরেকে কেউ কিছু করতে পারে না।’ | মনিরা বলল, আল্লাহ আমাকে মাফ করুন। আমি না জেনে করে ফেলেছি। আর কখনাে এমন কাজ করব না।

ঝর্ণা তারপর তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে এল। ঝর্ণা চলে যাওয়ার পর মনিরা মেয়েকে জিজ্ঞেস করল, তাের আন্টি সাইফুলের ঘরে গেল কি করে? নাজনীন বলল, আজ আসার পর থেকে আন্টির মনটা খারাপ দেখলাম। পড়াতে ভালাে লাগছে না বলে আমাদের বাসাটা ঘুরে দেখতে চাইলেন। সব ঘর দেখার পর মামার ঘরে ঢুকে চারদিকে তাকিয়ে কেমন যেন হয়ে গেলেন। তারপর মামার ফটোতে একবার হাত বুলিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। আমার কি মনে হয় জান আম্মা, আন্টি বােধ হয় সেই মেয়ে, যাকে মামা ভালবাসে। মনিরাও তাই আন্দাজ করেছে। তবু জিজ্ঞেস করল, কি করে বুঝলি?

নাজনীন এখন কলেজে পড়ছে। সব কিছু বুঝবার বয়সও হয়েছে। মায়ের কথা শুনে বলল, আজকের ঘটনা থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। তা ছাড়া মামার কথা আন্টি। প্রায় জিজ্ঞেস করে। তাের আন্টির নাম জানিস? ঝর্ণা। তাতেই তাে আমার ধারণা দৃঢ় হয়েছে।

মনিরা মেয়ের কথা শুনে চমকে উঠে ভাবল, তা হলে কি স্বামীর সঙ্গে ঝর্ণর। ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে? দু’দিন আগে সাইফুলের কথা শােনার পর ঝর্ণার হাবভাব লক্ষ্য। করে যে সন্দেহ হয়েছিল, আজকের ঘটনা শুনে সেই সন্দেহ আরাে দৃঢ় হল। ভেবে রাখল, ঝর্ণাকে এখন কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না। সাইফুল ফিরে এলে সত্যি-মিথ্যা যাচাই করে যা হয় করা যাবে।।

নাজনীনকে বলল, তুই তাের আন্টির সঙ্গে এমন ব্যবহার করবি, যেন তুই তার আসল পরিচয় জানিস না। ঐদিন বাসায় ফিরে এলে শিরীন তার মুখের করুণ অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করল, কিরে, তাের কি হয়েছে? তাের মুখ অত শুকনাে কেন? | ঝর্ণা ছলছল চোখে আজকের ঘটনা বলে বলল, জানিস, আমি সাইফুলকে যত জানতে পারছি তত ওকে ভালবেসে ফেলছি। ওর ভালবাসার গভীরত্বের কোনাে তল। পাচ্ছি না। সে কথা মনে হলে আমার অন্তরটা যেন ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না।।

শিরীন বলল, আল্লাহ তােকে সহ্য করার ক্ষমতা দিক। তুই কি সাইফুলকে চিঠি। দিয়েছিস? ঠিকানা জানতাম না। আজ নাজনীনের কাছ থেকে এনেছি। আজ চিঠিটা রাতে লিখে কাল পােষ্ট করে দিবি। রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর ঝর্ণা কাগজ কলম নিয়ে চিঠি লিখতে বসল। পত্রের প্রারম্ভে তােমাকে কি বলে সম্বােধন করব, তা ঠিক করতে না পেরে জায়গাটা ফাঁকা রাখলাম। আমি তােমাকে পত্র দেব, এটা যেমন তুমি ভাবতে পারছ না, তেমনি আমিও কোনাে দিন ভাবি নি। কিন্তু মানুষ নিয়তির কাছে বন্দি। নিয়তি কখন মানুষকে দিয়ে কি করাবে তা কেউ জানে না। আমিও মানুষ। তাই আমাকে নিয়ে নিয়তি যে খেলা খেলে চলেছে তা সহ্য করতে পারছি না। স্কুল জীবন থেকে তুমি আমাকে যত না ভালবেসেছ, তার চেয়ে অনেক বেশি আমি তােমাকে ঘৃণা করেছি।

| তুমি আমাকে চিনলেও আমি চিনি নি। আমিনের কপট ভালবাসায় পড়ে তােমাকে জব্দ করার জন্য তার ফাঁদে পা দিই। বিয়ের মাস খানেক পর তার আসল রূপ দেখে ভয়ে শিউরে উঠি। কিন্তু তখন আমার আর কিছু করার উপায় ছিল না বলে, ভাগ্যকে মেনে নিয়ে সামাল দেয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু ভাগ্য আমার প্রতি বিরূপ। তাই দুটো বছর আমিনের অকথ্য অত্যাচার সহ্য করে যখন সহ্যের বাইরে চলে গেল তখন পালিয়ে এসে এই ঠিকানায় এক বান্ধবীর বাসায় উঠি।

বান্ধবীর স্বামী ডিভাের্সের ব্যবস্থা করে দেন। তারপর ওনারই চেষ্টায় চাকরি করে ওনাদের কাছে আছি। ওনাদের কাছে। থাকতে কিতে আল্লাহপাক তার অপার করুনায় আমাকে হেদায়েৎ দান করে একদিকে যেমন ধন্য করেছেন, তেমনি তােমার সবকিছু জানিয়ে আমাকে দুঃখের ও অনুশােচনার সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছেন। তুমি আমার বিয়ের পর আমাকে যে কথা বলেছিলে, সেই কথার উপর ভসা করে এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে এই চিঠি লিখলাম। আমার জন্য তােমার এই পরিণতি হয়েছে জানতে পেরে পুরানা পল্টনের বাড়িতে তােমার রুমে একদিন গিয়ে যা দেখলাম, তাতে করে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

তােমার কাছে ক্ষমা চাইতে সাহস হচ্ছে না। কারণ যদি তুমি আমাকে ক্ষমা করে কাছে পেতে চাও, তা হলে কোন মুখে, কেমন করে এই অপবিত্র দেহ নিয়ে তােমার সামনে দাঁড়াব? আমার কারণে তুমি চিরকুমার থাকবে এবং আমার স্মৃতির যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মদ খেয়ে লিভার পচিয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছ জানতে পেরে আমার অন্তর অনুশােচনার আগুনে জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। জানি না কতদিন এই

আগুন সহ্য করতে পারব। বেশি কিছু লিখে তােমার ক্ষত বিক্ষত হৃদয়কে আরাে ক্ষত বিক্ষত করতে চাই না। শুধু আর একটা কথা বলে শেষ করছি, ঘৃণা করে জব্দ করতে গিয়ে তােমাকে যতটা শাস্তি দিয়েছি, আল্লাহপাক তার শতশতগুণ বেশি দৈহিক ও মানসিক শান্তি আমাকে দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। তােমার ভালবাসার কসম দিয়ে বলছি তুমি আমাকে যা শাস্তি দিয়ে তপ্তি পাও তাই দিও, তবু মদ ছেড়ে দাও এবং যত শিদ পার দেশে ফিরে এস। আল্লাহর কাছে তােমার সহিসালামতের এবং তােমাকে হেদায়েৎ করে দেয়ার জন্য দোয়া করে শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ। ইতি তােমার ভালবাসার পাত্রী।

অপবিত্রা ঃ ঝর্ণা। পরের দিন অফিসে যাওয়ার পথে চিঠিটা পােষ্ট করল। বিকেলে নাজনীনকে। পড়াতেও গেল।। নাজনীনের মায়ের কথামত এমনভাবে আন্টির সঙ্গে ব্যবহার করল, যেন। গতকালের ঘটনা সে জানে না।। নাজনীনের ব্যবহার দেখে ঝর্ণা স্বস্থি পেল । তবু ভাবল, গতকালের ঘটনায় এরা কি তা হলে কিছু বুঝতে পারে নি? চিন্তাটা দূর করে দিয়ে নাজনীনকে ভালভাবে পড়াতে লাগল। অসস ৰিম আ ৰু মাস তিনেক পর একদিন পড়ার সময় নাজনীন ঝর্ণাকে বলল, জানেন আন্টি, আগামীকাল মামা আসছে। কথাটা বলে সে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল তার। চেহারার কোনাে পরিবর্তন হয় কি না দেখার জন্য।

কথাটা শুনে ঝর্ণার মুখটা মুহুর্তের জন্য আনন্দোজ্জল হয়ে পরক্ষণে গভীর চিন্তার ছাপ ফুটে উঠল। যে পড়াটা বােঝাচ্ছিল সেটার দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল। নাজনীন যা বােঝার বুঝে গেল। বলল, আন্টি চুপ করে আছেন কেন? শরীর। খারাপ লাগলে আজ পড়া বন্ধ থাক।। ঝর্ণা নাজনীনের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, না, তেমন কিছু হয় নি, তুমি পড়।। পরের দিন ঝর্ণা অফিসে গিয়ে শুনল, আজ এগারটার ফ্লাইটে সাহেব আসছেন। তিনি অসুস্থ। তাই ছুটির পর অফিসের সব স্টাফ সাহেবকে দেখতে বাসায় যাবে।।

 

ঝর্ণা চিন্তা করতে লাগল সেও যাবে কিনা। এক মন বলল, তাের চিঠির উত্তর দেয় নি। তাতেই বুঝতে পারছিস না কেন, সে তােকে গ্রহণ করবে না। তাের যাওয়া উচিত না। আর এক মন বলল, যদি না যাস, তা হলে অফিস স্টাফরা তােকে কি ভাববে, সে সে কথা ভেবে দেখ। তুইতাে বােরখা পরে যাবি, তােকে সে চিনতে পারবে না। সবাইয়ের সঙ্গে তাের যাওয়া উচিত। গিয়েই দেখ না কি ঘটে?

মনিরা মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে গাড়ি করে এয়ারপাের্টে গেল। সাইফুলকে দেখে তারা। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। সে খুব রােগা হয়ে গেছে। চোখ-মুখ বসে যাওয়ায় তাকে চেনাই যায় না। সাইফুল তাদেরকে প্রবােধ দিতে দিতে গাড়িতে উঠল।

বুবু ও ভাগ্নির শত আকুতি-মিনতি স্বত্তেও সাইফুল পুরানা পল্টনের বাড়িতে না উঠে গুলশানের বাড়িতে উঠল। সেই বাড়ি দেখাশুনার জন্য দু’জন কাজের লােক ও একজন দারােয়ান সাইফুল রেখে গিয়েছিল।

দারােয়ান সাহেবের গাড়ি দেখে গেট খুলে দিয়ে সালাম দিল। কাজের লােক দুটো। বাসার সামনের ফাঁকা জায়গায় কি কাজ করছিল, তারাও এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে। গাড়ির পিছন পিছন এল।। খাওয়া-দাওয়ার পর মনিরা সাইফুলকে তার অসুখের ও চিকিৎসা করার কথা জিজ্ঞেস করল।
সাইফুল বলল, সেখানে অনেক চিকিৎসা করিয়েছি। ডাক্তাররা বলেছে, আগে মদ। ছাড়তে হবে তারপর লিভার যতটা নষ্ট হয়েছে, তা কেটে বাদ দিতে হবে। তবে এটা খুব রিস্কি। বাচতে পারি নাও পারি। কোনােটাই হয় নি।

মনিরা বলল, আমি এখানকার বড় বড় ডাক্তারদের নিয়ে বাের্ড তৈরি করে তাের চিকিৎসা করাব। সাইফুল স্লান হেসে বলল, করার সময় পার হয়ে গেছে। তা ছাড়া সেখানকার ডাক্তাররা যা পারে নি, তখন আর এখানকার ডাক্তাররা কি পারবে? এদের দৌড় কত, তা আমার জানা আছে। তুই সারা জীবন নিজের গয়ে চলেছিস। এখন আর সেই গয়ে কি করে চলিস। দেখব। আমার মনে যা আছে তা করবই।

সাইফুল আর কিছু না বলে চুপ করে রইল ।। মনিরা সাইফুলকে বিশ্রাম করতে বলে নাজনীনকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। সাইফল শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে লাগল, ঝর্ণা পুরানা পল্টনের বাড়িতে গিয়েছিল চিঠিতে লিখেছে। সে আমার ঐ বাড়ির খোঁজ পেল কি করে? চিঠিতে যে ঠিকানা। দিয়েছিল, সেটা তাে বন্ধু জায়েদের। জায়েদকে একবার ফোন করতে হবে। সেখানে এখনাে আছে কিনা? যদি না থাকে, তা হলে তার খোজ পাব কি করে? ঐ বাড়িতে। এসেছিল যখন, তখন নিশ্চয় তাকে বুবু ও নাজনীন চেনে। বুবুকে তাে তার কথা জিজ্ঞেস করতে পারব না, নাজনীনকে জিজ্ঞেস করতে হবে। এইসব ভাবতে ভাবতে মদ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। বুবুর চিঠি ও টেলেক্স পেয়ে সাইফুল ফিরে আসে নি। ঝর্ণার। চিঠি পেয়ে এসেছে। সেই সময় বেশি অসুস্থ থাকায় আসতে দেরি হয়েছে।

বিকেল চারটের সময় নাজনীনের ডাকে সাইফুলের ঘুম ভেঙ্গে গেল।। নাজনীন বলল, অফিসের সব লােকজন তােমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। ওনারা ড্রইংরুমে অক্ষো করছেন।

সাইফুল বলর, তুই যা, আমি তৈরি হয়ে আসছি।
নাজনীন ফিরে গিয়ে আম্মাকে অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে বলে তাকে সাহায্য করার জন্য তার কাছে রইল। নাজনীন তখন ভাবছে, আন্টিও এসেছে দেখলাম। আন্টিকে দেখে মামা কি করবেন এবং মামাকে দেখে আন্টি কি করবেন কি জানি।।

কিছুক্ষণের মধ্যে সাইফুল ড্রইংরুমে এল। | তাকে দেখে অফিস স্টাফরা দাঁড়িয়ে সালাম দিল। সাইফুল সালামের উত্তর দিয়ে সবাইকে বসতে বলে নিজেও বসল। তাকে দেখে সকলের চোখে পানি এসে গেল। তাই দেখে সাইফুল তাদেরকে প্রবােধ দিয়ে ভালাে-মন্দ জিজ্ঞেস করল। তারপর আপ্যায়নের পর সবাইকে বিদায় দিল।।

ঝর্ণা সকলের সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে হতবাক হয়ে গেছে। অনেকখানি জায়গার মাঝখানে খুব সুন্দর মডেলের দোতলা বাড়ি। গেটের উপরে বড় বড় অক্ষরে ঝর্ণালজ’ লেখা। তার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি চোখ মুছে সকলের পিছনে এসে ড্রইংরুমের এক কোণের দিকে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ সাইফুলকে দেখছিল। তার চেহারার অবস্থা দেখে ঝর্ণা চোখের পানিতে বুক ভাসাচ্ছিল। বােরখা পরা ছিল বলে কেউ তা দেখতে পায় নি। সাইফুল বােরখা পরা ঝর্ণাকে দেখেছে। প্রথমে সে মনে করেছিল, বুবুর জানাশােনা কোনাে পর্দানশীন মহিলা তাকে দেখতে এসছে। সকলে চলে যাওয়ার পরও মহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, কে আপনি? এতক্ষণ দাড়িয়ে রয়েছেন কেন? বসুন। তবু তাকে চুপ করে সেই অবস্থায় থাকতে দেখে সাইফুল দাড়িয়ে কয়েক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের রুমে চলে গেল।

| নাজনীন কিছুক্ষণ আগে এসে দরজার পর্দা ফাক করে সব কিছু দেখছিল। মামাকে আসতে দেখে সরে গেল। মামা চলে যাওয়ার পর ড্রইংরুমে ঢুকে ঝর্ণার কাছে এসে বলল, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন। তারপর জিজ্ঞেস করল, মামার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে?
সাইফুল যখন ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল তখন সে শত চেষ্টা করেও কথা বলতে পারে নি। কে যেন তার গলা চেপে ধরেছিল। শুধু চোখের পানি অবিরল ধারায় পড়ছিল। সাইফুল চলে যাওয়ার পরও তার চোখ থেকে পানি পড়ছে। নাজনীনের কথা শুনে সামলে নিয়ে চোখের পানি মুছে বলল, না।
আমাকে তােমার মামার রুমে নিয়ে চল, পরিচয় করব। নাজনীন আসুন বলে তাকে নিয়ে এসে মামার রুমের দরজার বাইরে দাঁড়াতে বলে সে ভিতরে গিয়ে মামাকে বলল, আমাকে পড়াবার জন্য যাকে তুমি ঠিক করে দিয়ে। গিয়েছিলে, তিনি তােমার সঙ্গে পরিচয় করতে এসেছেন।।

সাইফুল বলল, এখানে নিয়ে আয়। নাজনীন দরজার পর্দা ফাক করে বলল, আন্টি ভিতরে আসুন। ঝর্ণা ভিতরে আসার পর নাজনীন বেরিয়ে এসে দরজার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল।।
সাইফুল তাকে দেখে বুঝতে পারল, ড্রইংরুমের সেই মেয়েটি। বলল, ড্রইংরুমে আপনার পরিচয় জানতে চাইলাম, বললেন না কেন? চেয়ারের দিকে হাত বাড়িয়ে। বলল, বসুন।

Leave a Comment