প্রেম কাহিনী
Raj { Part 24}
হামিদ সাহেব সরাসরি স্ত্রীর কথার উত্তর না দিয়ে ভিজে গলায় বললেন,
জান আবসারের মা, কয়েকদিন ধরে ঝর্ণার কথা বড় মনে পড়ছিল। মেয়েটার কথা চিন্তা করে মনটাও খারাপ হয়েছিল। আল্লাহপাকের দরবারে শুকরিয়া জানাই, তিনি সেই। দুঃশ্চিন্তা থেকে আমাকে রেহাই দিলেন। তারপর তিনি চুপ করে গেলেন।
আফসানা বেগম স্বামীকে চেনেন। ভীষণ রাশ ভারি মানুষ। একটা কথা দ্বিতীয় বার। জিজ্ঞেস করলে রেগে যায়। নিজের ইচ্ছায় কিছু না বললে, একটা কথারও উত্তর দেয়। । স্বামীকে চুপ করে থাকতে দেখে ভাবলেন, আজ হঠাৎ ঝর্ণার কথা বলল কেন? তা হলে এই চিঠি কি সে দিয়েছে? সে কথা ভেবে আফসানা বেগমের চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। প্রায় রাত্রে শুয়ে শুয়ে মেয়ের জন্য কাঁদেন। একমাত্র মেয়েকে সেদিন তাড়িয়ে দিতে আফসানা বেগমের স্বামীর উপর প্রচণ্ড অভিমান হয়েছিল। সেই জন্য কোনােদিন তিনি স্বামীকে বা ছেলেদেরকেও ঝর্ণার খোঁজ নিতে বলেন নি। আজ স্বামীর। মুখে মেয়ের কথা শুনে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
হামিদ সাহেব এতক্ষণ গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। স্ত্রীর কান্নার আওয়াজ শুনে সম্বিত ফিরে পেয়ে বললেন, কাঁদছ কেন? আল্লাহপাকের ইচ্ছায় ঝর্ণা ভালাে আছে। দু'একদিনের মধ্যে স্বামীর সঙ্গে আসছে। তারপর তিনি বারান্দায় এসে চেয়ারে বসে একটা কাজের মেয়েকে দিয়ে তিন ছেলে ও তিন বৌকে ডেকে পাঠালেন। তারপর একজন চাকরকে বললেন, বৈঠকখানা থেকে ছ’সাতটা চেয়ার এখানে নিয়ে এস।
| মাত্র কয়েকদিন আগে হামিদ সাহেবের ছােট ছেলে সবুজ স্ত্রী ও এক ছেলে, এক। মেয়ে নিয়ে দেশে বেড়াতে এসেছে। সবুজের স্ত্রী এলিসার বাংলাদেশ দেখার খুব সখ । তাই স্বামীর সঙ্গে এসেছে। এলিসা খুব ভালাে মেয়ে। বিয়ের পর স্বামীর কাছে বাংলা। শিখেছে। বাংলা কিছু কিছু বােঝে এবং ভেঙ্গে ভেঙ্গে বলতেও পারে। খুব বুদ্ধিমান মেয়ে, এই ক’দিনে বাড়ির সকলের সঙ্গে বেশ এ্যাডজাস্ট করে ফেলেছে।
মারুফ অসুস্থ হয়ে দু’তিন দিন হল রংপুর থেকে বাড়িতে এসেছে। সবাই একে। একে বারান্দায় এসে বসল। আফসানা বেগম আগেই নিজের রুম থেকে স্বামীর পিছনে। পিছনে এসেছেন। সকলে আসার পর হামিদ সাহেব বললেন, আল্লাহ যার তকদিরে যা লিখেছেন তা হবেই। তাকে প্রতিহত করার ক্ষমতা কারাে নেই। ঝর্ণা এ বাড়ির একমাত্র মেয়ে। সে যত বড় অন্যায় করুক না কেন, তার তকদিরে যা ছিল তাই হয়েছে মনে করে তাকে আমাদের ক্ষমার চোখে দেখা উচিত। সে চিঠি দিয়েছে জামাইকে সঙ্গে নিয়ে দু'একদিনের মধ্যে আসছে। শুনে আফসানা বেগমের চোখে পানি এসে গেল, আঁচলে চোখ মুছে বললেন। চিঠিটা পড়ে শােনাও না।।
হামিদ সাহেব বড় ছেলে আবসারকে চিঠিটা দিয়ে পড়তে বললেন। আবসার চিঠিটা খুলে পড়তে লাগল। আব্বাজান ও আম্মাজান, (আসসালামু আলায়কুম)। আদৰ তসলিমৎ বহুৎ বহুৎ সালাম পাক কদমে পৌছে। ভাইয়াদের ও ভাবিদের সালাম এবং তাদের ছেলেমেয়েদের আন্তরিক দোয়া ও স্নেহাশীষ জানাচ্ছি। বাদ আরজ কাজ প্রায় পাঁচ বছর হতে চলল তােমাদের সবাইয়ের মনে কষ্ট দিয়ে চলে
এসেছিলাম। স্বল্প জ্ঞানের কারণে তখন আমি যে ভুল করেছিলাম, সে জন্যে তােমরা যেমন অশান্তি ভােগ করেছ তেমনি আমিও চরম অশান্তি ভােগ করেছি। আল্লাহপাকের অপার মহিমায় তিনি আমার দিকে করুণার দৃষ্টি দিয়ে কুরআন-হাসিদের জ্ঞান দান করে সেই পথে পরিচালিত করেছেন। সেই সঙ্গে আমাকে আমার অন্যায় কাজের সংশােধন করিয়ে নতুন জীবন দান করে ধন্য করেছেন। সেই জন্যে তাঁর পাক দরবারে হামেশা শুকরিয়া আদায় করছি।
আব্বা, তােমরা জেনে কি মনে করবে জানি না, যাকে বিয়ে করে তােমাদের সকলের মনে কষ্ট দিয়েছি এবং তুমি সে সময় তার সম্বন্ধে যা কিছু বলে গালাগালি করেছিলে, ঢাকায় ফিরে এসে তার সেই সব রূপ দেখলাম। টাকা নিয়ে আসতে পারিনি। বলে প্রথম দিকে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা দিত। তারপর অত্যাচারের উপর অত্যাচার চালিয়ে টাকার ব্যবস্থা করতে বলে। শেষে টাকা রােজগারের জন্য আমার ইজ্জতের উপর। হামলা চালায়। আমি রাজি না হতে ভীষণ মারধাের করে তাড়িয়ে দেয়। এটাই আমার ভুলের শাস্তি আল্লাহপাক নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। তারপর সেই করুণাসিন্ধু, যার। করুণা সারা বিশ্বে সর্বদা বর্ষিত হচ্ছে, আমার দিকে করুণার দৃষ্টি দান করে তার। রহমতের ছায়ায় নিয়ে নিরাপদ আশ্রয় দিলেন। এক বছর সেই আশ্রয়ে থাকার পর। আল্লাহর এক খাস বান্দার সঙ্গে তাঁরই ইচ্ছায় আমার দ্বিতীয় বিয়ে হয়। তাকে দেখলে।
তােমরা চিনতে পারবে। তােমাদের কাছে আমার একান্ত অনুরােধ, তােমাদের জামাইকে কোনােরকম অসম্মান করবে না। আমি তার এতটুকু অসম্মান সহ্য করতে পারব না। সম্মান দেখাতে না পারলেও অসম্মান করবে না। শুধু এইটুকু মনে রেখ, ওকে স্বামী হিসাবে পেয়ে আমি এত সুখ শান্তি পেয়েছি, তা তােমাদের বােঝাতে পারব। না। তাই আবার অনুরােধ করছি, তাকে অসম্মান করে আমাকে অশান্তির আগুনে নিক্ষেপ করাে না। আমরা ইনশাআল্লাহ ... তারিখ নাগাদ রওয়ানা দেব। তােমরা কে কেমন আছ জানি না। আশা করি, আল্লাহপাকের রহমতে ভালাে আছ। আমরাও তাঁরই করুণায় ভালাে আছি। সবশেষে তােমাদের পবিত্র কদমে সালাম জানিয়ে এবং আল্লাহপাকের দরবারে তােমাদের সকলের সহিসালামতের জন্য দোয়া চেয়ে শেষ। করছি। আল্লাহ হাফেজ।
ইতি তােমাদের অবাধ্য মেয়ে ঝর্ণা
চিঠি পড়া শেষ করে আবসার সকলের দিকে তাকিয়ে দেখল, সবাই আব্বার দিকে তাকিয়ে আছে।।
হামিদ সাহেব চোখ বন্ধ করে রয়েছেন। ওনার দু'চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।
সবুজের আমেরিকান বৌ এলিসা শ্বশুরকে উদ্দেশ্য করে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বলল, আপনি কাঁদছেন কেন? আজ তাে আনন্দের দিন। আমি আপনার ছেলের কাছে ঝর্ণার কথা কিছুটা শুনেছিলাম। এখন তার সমস্ত ঘটনা জেনে বুঝতে পারলাম। সে প্রথম। স্বামীর কাছে অনেক কষ্ট পেয়েছে। এখন দ্বিতীয় স্বামীর কাছে সুখে-শান্তিতে আছে। বর্তমান স্বামীকে আপনারা চেনেন লিখে জানিয়েছে। সে যেই হােক না কেন, ঝর্ণা তাকে পেয়ে যখন সুখী হয়েছে তখন তাকে আমাদের সাদরে গ্রহণ করা উচিত। আমার বিবেক তাই বলে।।
হামিদ সাহেব বিদেশী বৌয়ের কথা শুনে চোখ মুছে বললেন, তুমি ঠিক বলেছ মা। তারপর আল্লাহর শােকর আদায় করে বললেন, আল্লাহপাকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ কিছু করতে পারে না। তিনি যা কিছু করেন বান্দাদের মঙ্গলের জন্য করেন। জামাই যেই হােক না কেন, সবাইকে মনে রাখতে হবে সে এ বাড়ির জামাই। তাকে সেরকম সম্মান দেখাতে হবে। একবার ভুল করেছি, তার পুনরাবৃত্তি আর করতে চাই না।
| ঝর্ণার ভাইয়েরাও একমাত্র বােনের জন্য এতদিন অশান্তি ভােগ করছিল। তার খবর জেনে খুব খুশী হল। আব্বার কথা শুনে তারাও আল্লাহর শােকর আদায় করে বলল, ঝর্ণাকে ও তার স্বামীকে কোনােরকম অসম্মান করব না।
চিঠি পাওয়ার পরের দিন টেলিগ্রাম পেয়ে হামিদ সাহেব ছেলেদেরকে বললেন, আগামী কাল সন্ধ্যের দিকে ওরা এসে পড়তে পারে। তােমরা এর মধ্যে সমস্ত আত্মীয়স্বজন ও গ্রামের মানুষকে সংবাদটা জানিয়ে দাওয়াত করে তাদের খাওয়াবার ব্যবস্থা। কর। আমি সবাইয়ের সামনে মেয়ে-জামাই ঘরে তুলব।
গ্রামের মানুষ ও আত্মীয়-স্বজনেরা শুনেছিল, চেয়ারম্যান সাহেবের মেয়ে ঢাকায়। পড়াশােনা করতে করতে প্রেম করে বিয়ে করেছিল বলে তিনি মেেয়র কোনাে খোজখবর রাখেন নি। এখন শুনে তারা বলাবলি করতে লাগল, হাজার হােক একমাত্র মেয়ে, কতদিন আর রাগ করে থাকবেন। ঐদিন চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে দাওয়াত খেতে গ্রামের বহু লােকজন এসেছে। আত্মীয়-স্বজনে ঘর ভরে গেছে। সন্ধ্যের পর থেকে খাওয়ান হচ্ছে। এক সময় রাত সাড়ে আটটার দিকে একটা ট্যাক্সী চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ির সামনে এসে থামতে দেখে ছােট বড় অনেকে গাড়ির চারপাশে ভীড় করে দাড়াল।
ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে পিছনের গেট খুলে দিলে সাইফুল আগে নেমে সবাইকে সালাম দিল। তারপর ঝর্ণা ও নাজনীন নেমে সাইফুলের পাশে দাড়াল। বড়রা সালামের উত্তর দিয়ে অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। একটা ছেলে ছুটে গিয়ে হামিদ সাহেবকে খবর দিল। তিনি তখন মসজিদ থেকে এশার নামায। পড়ে ফিরছিরেন। খবরটা শুনে তিনি হন্তদন্ত হয়ে তাদের কাছে এসে সাইফুলের দিকে চেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। ততক্ষণে ঝর্ণার ভাইয়েরাও শুনে সেখানে এসেছে। সাইফুল তাদেরকে চিনতে পেরে সালাম দিয়ে কদমবুসি করতে গেলে ঝর্না ও। নাজনীন তাকে অনুসরণ করল।
হামিদ সাহবে অনেক দিন আগে সাইফুলকে দেখেছেন। তিনি স্কুলের সেক্রেটারী । ভালাে ছাত্র হিসাবে তাকে স্নেহ করতেন। ঝর্নাকে চিঠি দিয়েছিল বলে সেই সময়ে তিনি রেগে গিয়েছিলেন। কিন্তু পরীক্ষা না দিয়ে নিরুদ্দেশ হওয়ার কথা শুনে তার ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা ভেবে মনে একটু দুঃখও পেয়েছিলেন। জামাইকে দেখে সাইফলের কথা মনে পড়ল। ভাবলেন, জামাই অনেকটা সাইফুলের মতাে দেখতে। সাইফুল কদমবসি করে। দাড়াতে হামিদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ওসমানের ছেলে সাইফল না? সাইফুল জি বলে লজ্জা পেয়ে মাথা নীচু করে নিল ।।
হামিদ সাহেব তাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমাে খেয়ে বললেন, এতে লজ্জা পাওয়ার। কি আছে। আমাদের গ্রামের একজন সামান্য লােকের ছেলে হয়ে আল্লাহপাকের ইচ্ছায়।