Sompotti
Riya Singh
"কাকু এখানেই । হ্যা বটগাছের নিচে নামিয়ে দিন ।"
বলে অটোর ভাড়াটা মিটিয়ে যখন ব্যাগ নিয়ে সিদ্ধার্থ দাঁড়ালো তখন সূর্য ডুববে ডুববে করছে । চোখের সামনে একটা পুকুর ছাড়া তো কিছুই নেই ,বায়ে মুড়ে একটা বাড়ি দেখলো ঠিক ই সেটাকে বাড়ি না বলে ছোট খাটো শরীকি বাড়ি বলাই ভালো ।সামনে লোহার দরজাটা অনেক কষ্টে ও খুললো না যখন বাধ্য হয়ে পিছনে হাঁটা দেবে সিদ্ধার্থ ঠিক তখন ই ঘড়ঘড় আওয়াজ করে সদর দরজাটা খুললো আর পিছন থেকে আওয়াজ এলো -
" কে গা এই ভর সন্ধ্যে বেলায় আইছো ? বলি দিন করে আইসা যাই নি কো যতোসব।"
" এটা কি লবঙ্গ ব্যানার্জীর বাড়ি ?"
গেটের সামনে বড় বড় কইরা লেখা আইসে চোখে দেখো না নাকি !
বুড়ো লোকটার বলার পর সিদ্ধার্থের খেয়াল হলো গেটের একপাশে পিলারে কিছু একটা অস্পষ্ট লেখা আছে ।যেহেতু অনেক আগে লেখা সবটাই খসে খসে পড়ে গেছে তাও অনেক কষ্ট করে চোখটা ছোট করে পড়ার পর মনে হলো লেখা "লাবণ্য ভিলা"
"কোই গেলা আবার , সন্ধ্যা নেমে আসছে আমাগো আবার সব দরজা বন্ধ করে দিতি হইবো। তা তুমি কে হে ছোঁড়া ?"
- আমি সিদ্ধার্থ লবঙ্গ ব্যানার্জীর দূর সম্পর্কের ভাইপো ।
- আসো দেহি ,আগে বলবা তো মা ঠাকুরণের কুটুম ।মা জানিতে পারিলে আমাকে আর আস্ত রাখবি নে ।
বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে সিদ্ধার্থ খেয়াল করলো অসম্ভব রকমের চুপচাপ আর প্রচন্ড পরিমানে শান্তি ছেয়ে আছে । কাছাকাছি কোথাও একটা পেঁচা থাকলো বোধহয় ।
- তুমি এখানে বসো আমি মা ঠাকুরণকে ডেকে আনি গা।
- আচ্ছা ,একটু জল হবে সেই সকালে বেরিয়েছি পিপাসা পেয়েছে।
- দিচ্ছি আপনি আগে বসুন দেহি।
- এই কে কোথায় আছিস জল খাবারের ব্যবস্থা কর ।
এটা বলার পর ঠিক অন্ধকারের মধ্যে থেকে দুটো মানুষ উদয় হলো সিদ্ধার্থের মুখোমুখি । অন্ধকারে ঠাউর করা না গেলেও এটুকুই বোঝা গেল দুটো মানুষ একঠায়ে সিদ্ধার্থের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শুধু ওকেই দেখছে । আসা থেকে এক ঝলক আলোর দেখা নেই ,ঠিক এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিজেকে কেমন যেন ভুত ভুত লাগছে সিদ্ধার্থের, তার উপর আলো ছাড়া দমবন্ধ লাগছে ।যেন মনে হচ্ছে এই বুঝি শ্বাস আটকে মারা যাবে ।
যাইহোক ঘন্টাখানেক পরে ও যখন জলের দেখা মিললো না ততক্ষনে সিদ্ধার্থের গলা শুকিয়ে কাঠ আর সহ্য হলো না জলের পিপাসা, বাধ্য হয়ে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে জল খুঁজতে খুঁজতে কারোর সাথে ধাক্কা লেগে গিয়ে যখন সামনে তাকিয়ে দেখলো সেই গেট খোলার লোকটাকে যে এখন মোমবাতি জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে সিদ্ধার্থ কে দেখে বললো -
" এই বড় বাড়িতে কোই যাইবেন ,বসুন দেখি এই নিন জল ।"
একনিমিষে জলটা খেয়ে গ্লাসটা রাখার পর সিদ্ধার্থ বুঝতে পারলো জল না পেলে এই মুহূর্তে এখানে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকতো আর কেউ জানতেও পারতো না।
চলুন আপনাকে খেতে দি তারপর আপনাকে মা ঠাকুরনের কাছে নিয়ে যাবো।
পিসিমা আসবেন না?
উনি বিছানায় শুয়ে আছেন , হাঁটতে পারেন না।
ওহ বেশ আমিই তাহলে কথা বলে নেবো । আপনার নামটা একটু যদি বলেন ...
কালীপদ আমাকে কালী বলে ডাকবেন।
পিসিমার ঘরটা কোথায় একটু দেখিয়ে দিন ।
চলুন আমার সঙ্গে।
কালীপদর সঙ্গে কিছুক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে যে ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম । এই ঘরের মধ্যে আলো আছে মানে দুটো মোমবাতি একটা হ্যারিকেন আছে কিন্তু এটা বাদে সারাবাড়ি অন্ধকারে ডুবে আছে।
বিছানায় একজন শুয়ে আছেন দেখে মনে হলো বয়স্ক অনেকটাই । তার সামনে চেয়ার পাতা ,হাতের ইশারায় আমাকে ডেকে বসতে বলছেন ।
- নমস্কার পিসিমা ।
- বেঁচে থাকো বাবা। আমি উঠতে পারলে তোমার দেখাশোনা আমিই করতাম ।
- না না ঠিক আছে আপনি নাকি অসুস্থ শুনলাম।
- হ্যা বাবা ।আদর যত্নে কোন ত্রুটি হয়নি তো।
- না না কিসব বলছেন ।বলছি যে আপনি চিঠি পাঠিয়েছিলেন বাবাকে তাই না !
- আসলে শরীরটা আজকাল ভালো নেই ,কখন কি হয়ে যায় । তাই আমি চাই তুমি এই সব সামলাও ।
- আপনার ছেলে ?
- তাকে আমি কবেই ত্যাগ দিসি বাবা । লোভী মানুষের হাতে কিছু দিয়ে মরেও শান্তি পাবো না , তার থেকে যখন যোগ্য উত্তরসূরি আছে তাকেই না হয় সবটা দি। কালীপদ নিয়ে আয় সব।
- এই নিন ।
- এটা কি?
- খোলো বাক্সটা ।
- কাগজপত্র আর গয়না এতো দামী জিনিসপত্র আপনার তো ।
- এই বাড়ির দলিল আর কিছু সোনা দানা আছে। আর একটা চিঠি তোমার বাবার জন্য। যাও রাত হলো খেয়ে ঘুমোও । কাল তোমাকে গাড়িতে তুলে দিবে ক্ষণ কালী।
খাওয়ার সময় সিদ্ধার্থ দেখলো বেশ তড়িবৎ করেই তাকে খেতে দেওয়া হয়েছে কিন্তু এইটুকু সময়ে কিভাবে তা ভেবেও চুপচাপ খাওয়া সেরে উঠে পড়লো ।
হাতটা ধুয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে সিদ্ধার্থ দেখলো ফোন বন্ধ । আসার সময় ফুল চার্জ দিয়েই এসেছিল যতোদূর মনে আছে তবুও অদ্ভুত তো....
যে ঘরে সিদ্ধার্থ থাকতে দেওয়া হয়েছে ঘরটা বেশ বড় ,একটা টেবিল , আলমারি আর বেশ রাজকীয় পালঙ্ক রাখা আছে।
তুলতুলে বিছানায় শুতেই সারা রাজ্যের ঘুম চলে এলো ।
গভীর ঘুমটা ভাঙলো কিছু চেঁচামেচি করার আওয়াজে । দেওয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে সিদ্ধার্থ দেখলো সোয়া দুটো বাজে ,কোথাও একটা শিয়াল ডেকেই চলেছে।দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে নিঝুম অন্ধকার হাতড়ে সিদ্ধার্থ বুঝলো চিৎকারের আওয়াজ টা ডান দিকের থেকে আসছে । ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে আওয়াজ টা অনুসরণ করে সিদ্ধার্থ শুনতে পেলো -
" -তুমি আমাকে বাড়িটা লিখে দেবে হ্যা কি না ?
"- এই শরীরে পরাণটা যতক্ষণ আছে আমার উত্তর না ।
- তুমি দেবে না তাইতো। ঠিক আছে আমি ও জানি সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে কি করে আঙুল বাঁকাতে হয় ।
- কি করবি তুই ? মদ খেয়ে আমাকে মারবি ।মার দেখি কত সাহস ।
- ছোটকর্তা দোহাই আপনার কাছে এসব ছেড়ে দিন । আপনি ঘরে ফিরে আসুন।
- শালা চাকর শুয়োরের বাচ্চা তোকেই আগে মারবো। এই বুড়ির যত বেশি সাহস তোর জন্য শালা
- ধীরেন আমি জানতাম তুমি কুলাঙ্গার কিন্তু অমানুষ আজ জানলাম।
- জেনে গেছিস এবার দলিল বার কর জলদি নয়তো ।
- মারবি তো আয় ।
- ছেড়ে দিন ওনাকে ছোট কর্তা ।
- আআআ...
- এটা কি করলি তুই!
- আমি তো শুধু ছাড়াতে গেছিলাম মা ঠাকুরণ। বিশ্বাস করুন আমি ওনাকে মারতে চাইনি ।
- কালীপদ ।
- বলুন ।
- লাশটাকে পিছনের দিকে উঠোনে কবর দিয়ে আয়। আর খবরদার কেউ না জানো জানতে পারে।
- আজ্ঞে ক্ষমা করুন ।
- যা হওয়ার হয়েই গেছে ,আজ না মরলে কাল আমাকে মেরে ফেলতো ভালো হয়েছে এমন জানোয়ার কে জন্ম দিয়েছিলাম আমি । তুই যে ওকে কোলেপিঠে মানুষ করেছিস তার গলা টিপে দিতে দশবার ভাবলো না ।
- এই দৃশ্যটা দেখার পর আমার সারা শরীর যেন অসাড় হয়ে গেছিল। একটানা ঢোক গিলতে ও ভুলে গেছিলাম। এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল একছুটে দৌড়ে চলে যাই বাড়ির সীমানা পেরিয়ে । মায়ের বলা কথাগুলো যেন কানে বাজছিল -
বাবু সত্যি ই তুই যাবি , কিন্তু আমার মনটা যে খুঁতখুঁত করছে। থাক না ছাড় ওসব বাড়ি চাই না ।
এখন তাই বলতে ইচ্ছে করছে -
" তোমার কথা শুনলে বোধহয় ভালো হতো "
এরপর আমার জ্ঞান ফিরে ছিল স্টেশনের এক বেঞ্চিতে। সাথে শরীরে অজস্র যন্ত্রণা । কোনরকমে বাড়ি ফিরে টাইফয়েডে ভুগে ছিলাম। ঘটনার ঠিক একমাস পর বাবা খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারে পিসি বছর দুয়েক আগেই মারা গেছে আর ওনার ছেলের খোঁজ খবর নেই। মাঝে মাঝে আসতো টাকা-পয়সা কেড়ে নেওয়ার জন্য , তারপর একদিন বেপাত্তা হয়ে যায়।
মা একদিন আমার সেই ঘুরতে যাওয়ার ব্যাগ একটা বাক্স পেয়ে আমাকে দেখায়। ওই বাক্সতে পিসিমার দেওয়া দলিল আর সোনার গয়নাগুলো ছিল । সত্যি ই কি তাহলে ওই বাড়ি গেছিলাম নাকি সবটাই স্বপ্ন ছিল যদি স্বপ্ন ই হয় তাহলে এগুলো এলো কোথা থেকে !
Writter :- Riya Singh