Prem Kahini
Raj { Part 16 }
সে কি করবে না করবে তা জানার আমার দরকার নেই। তা ছাড়া তার কোনাে মতামত আমি মেনে নেব না। আর আমার ভাবনা চিন্তা করারও কিছু নেই। এ জীবনে আমি আর তার কাছে ফিরে যাব না।।
তবু কিন্তু কিছু কথা থেকে যাচ্ছে। শিরীন বলে উঠল, এর মধ্যে আবার কি কথা থাকতে পারে? ঐ পাষণ্ডের সঙ্গে আর মিটমাট হতে পারে না। ঝর্ণা যা বলল, তাই কর।। জায়েদ বলল, ঠিক আছে, একদিন সময় করে আপনাকে একজন উকিলের কাছে নিয়ে যাব। তারপর ঝর্ণাকে বলল, এখানে আপনার কি এমন অসুবিধে হচ্ছে, যে জন্য। ঘাড়ে বসে খাওয়ার কথা বলছেন?
অসুবিধে কেন হবে, বরং সুখেই আছি।
শিরীন বলল, তুই এখানেই থাকবি। কোথাও তাের যাওয়া চলবে না। একা মেয়েছেলেকে কেউ সহসা ঘর ভাড়া দেবে না। আর যদিও বা কেউ দেয়, তাের সেখানে একা থাকাও ঠিক হবে না। সেই পাষণ্ডটা তােকে এত সহজে ছেড়ে দেবে বলে মনে করেছিস বুঝি? ঐ রকম ধরণের লােকেরা বড় ডেঞ্জারার্স। রাস্তা-ঘাটে তুই একা। চলাফেরা করার সময় খুব সাবধানে থাকবি। তাই বলে কতদিন তােদের ঘাড়ে বসে খাব? অবশ্য আমাকে পেয়িংগেস্ট হিসাবে। রাখলে অন্য কথা।
শিরীন একটু রাগের সঙ্গে বলল, রােজগার করতে শিখে টাকার গরম দেখাচ্ছিস? তুই ভুল বুঝচ্ছিস কেন? বিপদের সময় তােদের কাছ থেকে যে উপকার পেয়েছি, চিরকাল সে জন্য কৃতজ্ঞ থাকব। এখন আল্লাহ আমাকে স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষমতা দিয়েছেন, এখনাে পরগাছার মতাে থাকা কি উচিত?
শিরীন বলল, ঠিক আছে, তাের যা মনে চায় তাই কর। কিন্তু তােকে একা অন্য কোথাও থাকতে দেব না।। কাদেয় ক্লিম সুকান্ত এক বছর হতে চলল ঝর্ণা শিরীনদের বাসায় পেয়িংগেস্ট হিসাবে থেকে চাকরি করছে এবং নাজনীনকে প্রাইভেট পড়াচ্ছে। নাজনীন ঝর্ণার কাছে প্রাইভেট পড়ে ফাস্ট ডিভিশনে এস.এস.সি. পাস করল। পরীক্ষার পর ঝর্ণা প্রতিদিন নাজনীনকে শুধু গ্রামার ও ট্রানশ্লেসান করাতে আসে।
যে দিন রেজাল্ট বের হল, সেদিনও ঝর্ণা পড়াতে এল। সে অফিসে খবরের কাগজে নাজনীনের রােল নাম্বার দেখে তার রেজাল্ট জেনেছে। নাজনীন নিজের রুমে আন্টির জন্য অপেক্ষা করছিল। সে ঝর্ণাকে আন্টি বলে ডাকে। ঝর্ণা ঘরে ঢুকতে এগিয়ে এসে প্রথমে সালাম দিয়ে বলল, আন্টি আজ আমাদের রেজাল্ট বেরিয়েছে। আমি ফাস্ট ডিভিশানে তিনটে লেটার পেয়ে পাশ করেছি। তারপর সে কদমবুসি করল।
ঝর্ণা তার মাথায় হাত চুয়ে চুমাে খেয়ে হাসি মুখে বলল, আমি অফিসে পেপার দেখে আগেই জেনেছি।। আন্টি, আজ পড়তে ইচ্ছে করছে না। বেশ তাে, না হয় না পড়লে, তাতে কি? আজ কি আর কেউ পড়াশােনা করতে পারে? আপনি বসুন, আমি আসছি বলে নাজনীন চলে গেল। একটু পরে একটা প্লেটে বেশ কয়েক রকমের মিষ্টি নিয়ে ফিরে এসে টেবিলের উপর রেখে বলল, আম্মা মিষ্টি মুখ করতে বলল। ঝর্ণা বলল, তা তাে করবই। তুমি খাও।। একটু আগে আম্মা আমাকে খাইয়েছে।
ঝর্ণা মিষ্টির প্লেটের ঢাকা দেয়া প্লেটে তিন চারটে মিষ্টি তুলে দিয়ে বলল, আম্মা খাইয়েছে এবার আন্টি খাওয়াবে। নাও এগুলাে খেয়ে ফেল। নাজনীনের খাওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও আদব রক্ষার্থে দুটো খেল। তারপর বলল, আজ মামার চিঠি এসেছে। আমার রেজাল্টের খবর জানাতে বলেছেন। জানেন আন্টি, মামার অসুখ আরাে বেড়ে গেছে। ঝর্ণারও খাওয়া শেষ হয়েছে। এমন সময় মনিরা এসে ঝর্ণাকে সালাম দিল।
সেই প্রথম দিনের পর ছাত্রীর মাকে দীর্ঘ এক বছর পরে তার কাছে আসতে দেখে ঝর্ণা বেশ অবাক হল। সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কেমন আছেন? মনিরা বলর, আল্লাহর রহমতে ভালাে আছি। তারপর নাজনীনকে বলল, তুমি প্লেটগুলাে নিয়ে যাও। আমি তােমার আন্টির সাথে আলাপ করব। নাজনীন চলে যাওয়ার পর ঝর্না বলল, নাজনীন বলছিল, আপনার ভাইয়ের অসুখ আরাে বেড়েছে। ওনার কি অসুখ? লিভার নষ্ট হয়ে গেছে। এখানেই অসুখটা হয়েছিল। তেমন গুরুত্ব দেয় নি। আপনারা সে সময় ট্রিটমেন্ট করাতে বলেন নি?
সাইফুল ছেলেবেলা থেকে বেপরােয়া স্বভাবের। কারাে কথা নেয় না। নিজে যা ভাবে তাই করে। আব্বা-আম্মার কথাই নেয় নি, আর আমার কথা শুনবে। সাইফুলের নাম শুনে ঝর্ণা চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, আপনার কি আরাে একটা ভাই আছে? মনিরা তাকে চমকে উঠতে দেখে বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন বলুন তাে? সাইফুলই আমার একমাত্র ভাই।।
যিনি আমাকে নাজনীনকে পড়াবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, তিনি আপনার ভাইয়ের নাম আরজু বলেছিলেন। ও তাই বলুন। আমি মনে করেছিলাম, আপনি সাইফুলকে চেনেন। আরজুর আসল নাম সাইফুল। এই বাড়ি যাদের ওনাদের সাইফুলের মতাে একটা ছেলে ছিল। ছেলেটা কলেজে পড়ার সময় মারা যায়। তার নাম ছিল আরজু। সাইফুলকে পেয়ে উনি ও ওনার স্ত্রী ছেলের শােক ভুলে যান এবং সাইফুলকে নিজের ছেলে করে লেখাপড়া করান। ওনারাই সাইফুলের নাম পরিবর্তন করে নিজের ছেলের নামে ডাকতেন।
| মনিরার কথা শুনে ঝর্ণার মনে অনুশােচনার ঝড় বইতে শুরু করেছে। অনেক কষ্টে সংবরণ করে বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব কিছু মনে করবেন না। আপনার ভাই কি এখনাে বিয়ে করেন নি?
না। আব্বা-আম্মা কত চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কিছুতেই ও রাজি হয় নি। আপনাদের দেশের বাড়ি কোথায়? কুড়িগ্রাম জেলার অনন্তপুর গ্রামে। শুনে ঝর্ণা আবার চমকে উঠল। শিরীনের স্বামীর কাছে তার বন্ধুর হিস্ট্রী শুনে ঝর্ণা যে কথা অনুমান করে সন্দেহের দোলায় দুলছিল, মনিরার কথা শুনে নিশ্চিত হল, আরজুই সাইফুল। একটু আগে সাইফুলের নাম শুনে অনুশােচনার যে ঝড় মনে বইত শুরু করেছিল, তা এখন প্রবল আকার ধারণ করল। চোখে পানি এসে গেছে বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে চোখ মুছে। নিজেকে সামলাবার প্রাণপণ চেষ্টা করল। তারপর মাথা তুলে জানা সত্ত্বেও অসুখ কতটা সিরিয়াস তা জানার জন্য জিজ্ঞেস করল, আপনার ভায়ের লিভার নষ্ট হল কি করে?
ঝর্ণার হাবভাব দেখে মনিরার মনে সন্দেহ হল। এখন যেন তাকে হামিদ চেয়ারম্যানের মেয়ে বলে একটু একটু মনে পড়ছে। সন্দেহটা যাচাই করার জন্য সাইফুলের সব কথা বলতে আরম্ভ করল। সে কথা আর জিজ্ঞেস করবেন না। সাইফুল। পড়তে পড়তে বিলেত চলে যায়। এই বাড়ির মালিক ও ওনার স্ত্রী মারা যাওয়ার খবর পেয়ে ফিরে এসে আমাদের সবাইকে দেশ থেকে নিয়ে আসে। আমাদের আনার পর। গুলশানে বাড়ি করে ওখানে একা থাকত। শুধু অফিস থেকে এখানে খেতে আসত। আব্বা-আম্মা মারা যাওয়ার কিছু দিন পর একদিন আমাকে বলল, এখানে আমার। কিছুতেই মন টিকছে না। আমি আবার বিলেত চলে যাব। ওকে নিষেধ করে কোনাে ফল হবে না ভেবে কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। তারপর বেশ কয়েকদিন ওর খােজখবর নেই। অফিসে ফোন করে পাওয়া যায় না। দুপুরে এখানে খেতে আসে, তাও। আসে না।
একদিন সন্ধ্যের পর আমি গুলশানের বাড়িতে গেলাম। তখনও সে ফিরে। নি। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। রাত দশটার দিকে মাতাল হয়ে টলতে টলতে। ফিরল । সাইফুল মদ খাবে, তা আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না। প্রচণ্ড বেগে গিয়ে। তার গালে একটা কষে চড় মেরে বললাম, তুই ধার্মিক ছেলে হয়ে মদ খাস? আল্লাহপাক মদকে হারাম করেছেন, তা ভুলে গেছিস? আমার চড় খেয়ে সাইফুলের চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে পড়ল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে মাথা নিচু করে রইল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বুবু, তুমি আমাকে যত ইচ্ছা মার আর বকাবকি কর, তাতে আমি কিছুমনে করব
মদ ধরেছি কেন শুনবে? তারপর চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, আমি হেরে গেছি বুবু। ঝর্ণা আমার সবকিছু কেড়ে নিয়ে হারিয়ে দিয়েছে। সেই পরাজয়ের গ্লানী ভলে থাকার জন্য প্রথমে দেশ ছাড়লাম, তাতে কাজ না হতে মদ ধরেছি। তবু যে। তাকে ভুলতে পারছি না বুবু। আমি ছােটবেলা থেকে যে স্বপ্ন দেখে এসেছি, তা ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেছে। ওর কথা শুনে মনে হল, মদ খেয়ে মাতলামি করছে। তাই আরাে রেগে গিয়ে তার দ’গালে বেশ জোরে কয়েকটা চড় মেরে বললাম, মদ খেয়ে ঘরে এসে মাতলামি করা হচ্ছে। সাইফুল মারকে গ্রাহ্য না করে আমার দু’পা জড়িয়ে ধরে কাদতে কাদতে বলল, বুবু তুমি আমাকে আরাে মার। ঝর্ণা যে হঠাৎ বিয়ে করে ফেলবে, তা কল্পনাও করতে পারি নি। ঘুণাক্ষরে যদি বুঝতে পারতাম, তা হলে যেমন করে হােক তার বিয়ে বন্ধ। করে দিতাম। সব থেকে বড় কথা কি জান বুবু, যার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে, সে ছেলেটা ভালাে নয়।। ওর কথা শুনে মনে হল, মদ খেলেও মাতলামি করছে না। বললাম, ঝর্ণা কে?
বলল, তােমার মনে নেই বুবু, আমাদের গ্রামের হামিদ চেয়ারম্যানের মেয়ের কথা? ক্লাস টেনে পড়ার সময় তাকে চিঠি দিয়েছিলাম বলে সেই চিঠি হেডস্যারের কাছে দিয়ে আমাকে মার খাইয়েছিল? সেজন্যে আমি পড়া ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় পালিয়ে আসি। সেই ঝর্ণা ভার্সিটিতে পড়ত। তিন বছরের বেশি হয়ে গেল আমিনের সাথে তার বিয়ে হয়ে গেছে। ওকে ভুলে যাওয়ার জন্য মদ খাই। তবু যে ভুলতে পারছি না। কি করলে ওকে ভুলতে পারব, তুমি বলে দাও না বুবু। আমি যে আর পারছি না।
Related Story
ওর এই পরিণতির কারণ জানতে পেরে আমারও খুব দুঃখ হল। ভাবলাম, সাইফুল ছােটবেলা থেকে ধর্মের আইন মেনে চলে। একটু বড় হতে গ্রামের কেউ। অন্যায় কিছু করে পার পেত না। মাতবররা সাইফুলকে ছাড়া বিচার করত না। গ্রামের ছােট-বড় সবাই সাইফুলকে ভালবাসত। সেই সাইফুল ঝর্ণাকে না পেয়ে মদ খাচ্ছে? বললাম, কাউকে ভালবাসা পাপ নয়। তুই ঝর্ণাকে ভালবাসিস, সেটা ভালাে কথা। কিন্তু তাই বলে তাকে না পেয়ে আল্লাহর হুকুমের বরখেলাপ কাজ করছিস কেন? একটা। মেয়ের জন্য তাের মতাে শিক্ষিত ছেলের এটা করা উচিত হয়েছে? অনেক সময় অনেক জ্ঞানী-গুণীজনও সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে শয়তানের প্ররােচনায় অন্যায় করে ফেলেন। তােরও তাই হয়েছে। তুই আমাকে যে কথা জিজ্ঞেস করলি, তার সমাধান বলছি, তুই। একটা ভালাে মেয়ে দেখে বিয়ে কর। তা হলে দেখবি, প্রথম দিকে একটু খারাপ। লাগলেও ধীরে ধীরে ঝর্ণাকে ভুলতে পারবি।।
এই কথা শােনার পর সাইফুল বলল, তাও আমি চিন্তা করে দেখেছি। কিন্তু অন্য কোনাে মেয়ের কথা ভাবলে ঝর্ণার স্মৃতি আমাকে আরাে অস্থির করে তুলে। তুমি আমাকে বিয়ের কথা বলাে না বুবু। তার চেয়ে আমার খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দিও। তারপর সে ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকল।
আমি তাকে সেদিন অনেক বুঝিয়ে এই বাসায় ফিরে এলাম। কিন্তু কিছুতেই মদ ছাড়ল না। বরং এরপর থেকে আরাে বেশি মদ খেতে লাগল ।
জানেন, সাইফুল ঝর্ণাকে এখনাে এত ভালোবাসে তা আপনাকে বলে বুঝাতে পারব না। গুলশানে যে বাড়িটা করেছে, সেটার নাম দিয়েছে ঝর্ণালজ। আর কত রং বেরং এর স্যালওয়ার, কামিজ,